প্রশান্ত বারিক

 

স্বপ্নে দুঃস্বপ্নে 

প্রশান্ত বারিক


পাতালের গহীন আঁধারে তামাবরণ দেহ ভাসিয়ে 
চেটচেটে আঠালো কলঙ্ক জ্যোস্নায়  রুবরু হওয়া গেলো আজ 
জলজ লতা গুল্ম দোলমাদল ঈষৎ আঁশ আঁশ গন্ধের অম্লকটু সোয়াদ  
অগ্নিজিহবায় চেটে নেওয়া  গেলো  নেশাঘোর এই অদ্ভুত আঁধারে 
রক্তের ভেতরে কলকল ধ্বনি শোনা গেলো রুপোলি ঝরনার...

একটি তেঁতুলিয়া বিছে সরুসরু একশোআট পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে 
সমস্ত শিরা তন্তু মজ্জা ও ঘিলুর ভেতর। .......
বিজবিজে ঘাম কপালে -বুনোঘাস চুলের- গোড়ায় 
চেটালো লোমশ বুকের উপর হটাৎ দেয়াল থেকে খসে পড়ে সঙ্গমরত টিকটিকি 

তীব্র মরুঝড়-তুষার ঝঞ্ঝায় মুখ থুবড়ে চোরাবালির ভেতর হাত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে 
গিরিখাদের থেকে ছুটে আসা বিদেহী আত্মাদের একটানা  বুকচাপা গোঙানি দু কানের ভেতর -
হে আকাশ আলো দোও -এল দোও সবুজ ভোরের। ...
বোমায় বিধ্বস্ত শহরের পথে শিশুটি তার মা'কে খুঁজছে -
দুধেভরা স্তনবৃন্তের নমনীয় উষ্ণতায় তাকে আজ কে পঁহুনছে দেবে ?
পাঁজরে সাপ জড়িয়ে অমরিলতার ছায়ায় শুয়ে ভুকাপেঠ একাবোকা দুঃখী মানুষ 

খরায় শুকিয়ে যাওয়া জলাভূমির ফাটাবুকে ছোটো ছোটো  মৃত রুপোলি মাছেদের 
সারিসারি করুণ  শরীর -
তা দেখে শাক খুঁটতে আসা রোগা রোগা মেয়েটির ছেঁড়া গামছায় ডালিম বুক দীর্ঘস্বাস ছাড়ে।.......

চৈত্রের ধুলিপথে লাউতুম্বার ধ্বণি তুলে ঘর -ফিরতা ধনু বৈরাগী 
একমুঠো আমানিভাতের প্রলোভনে খালপাড়ের আখড়ায় নিয়ে যায় তাকে 
সহসা জ্বার ওঠে ,নোনাজল ছোঁয় -কালের চরণ  ...
পুরুষের পাপবিজ আর বালিকার দীর্ণ কুসুমরক্তে লতপত ছেঁড়াগামছা 
ঢুকে যায় -ঢোলকলমি শুষনিভরা পাঁকে ওমায়.....


             

 ভাগাড় 


মাথায় কাফন প্রেত কয়জন হাইরাইজ অন্ধকারে খুঁটে নিচ্ছে ওম ওয়েভ তরঙ্গের
তাদেরকে কাশবন কেয়াফুল আর আঁকাবাঁকা ডুলুংএর কথা শোনাতে যেতেই 
পোড়া চোয়াল নেড়ে হিস্হিসিয়ে  উঠলো সবাই 'এটা নকশিকাঁথার যুগ নয় রে দামড়া -
রোবোটিক  মিথেন অন্ধকারের যুগ -----
নুলা -ঠুঁটা ,তুই বসে আছিস অন্তহীন ভাগাড়ের ভেতর 

গুরু দ্রোণাচার্যের চরণধূলিমাখা  গাঁওউজাড় প্রান্তরে তখন -
স্তব্ধ ক্রেনের  মাথায় ক্ষয়রোগি চাঁদ, সেই চাঁদের আলোয়
তুফানী-শেরশাহী রোদের ঝলমলে হোটেল রেস্তোরাঁয়  পাহাড় জঙ্গল 
সমুদ্রতীর  থেকে উপড়ে আনা দিশাহীন অসংখ্য যুবকযুবতীর জীবন যৌবন নিলাম হয় যায় । .........

চারপাশে ঘোড়েল বাতাস বয় 
ঘরফেরতা দুই বারসুন্দরীকে জবরণ তুলে নিয়ে যায় কয়জন মদ্যপ  পিশাচ  
গুরুগ্রামের দরমাঘরে  বসে নদীয়ার মদন গোঁসাই -
ফুসলিয়ে আনা কচি বৌটিকে পাশে নিয়ে রাধে রাধে গায় 

স্থবির আমার সামনে দিয়ে ওয়েভ তরঙ্গের ভেসে যান বিষাদমগ্ন
তুতেনখামেন-সক্রেটিস-রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-লেওনার্দো দা ভিঞ্চি-
রবীন্দ্রনাথ-চৈতন্য-বিদ্যাসাগর-রামমোহন ভেসে যায়-বাংলার রেনেসাঁ 
নক্সালবাড়ি কাদোপিঁডরা নয়াগ্রাম গোপীবল্লভপুর পলাশীর প্রান্তর 
সালভাদোর দালির ঘড়ি গুলো হাইপারটেনশন গলে গলে পড়ে অসহ্জ নীলে। ...

হড়হড়ে পুঁজ রক্ত বমনে পিছলে পিছলে যায় দুঃসহ সময় 
পিছলে যায় বালিকার চিৎকৃত নাভিপিন্ড ,কিশোরের মুণ্ডুহীন ধড়,
পিছলে যায় অসংখ গৃহবধূর ছেড়াঁখোঁড়া আধপোড়া শরীর। .....
মেট্রো সুড়ঙ্গে হ্যাপিস মাইগ্রান্ট লেবারদের অতৃপ্ত কঙ্কালগুলো লাফায় বাইরে আসার তাড়নায় 

ক্ষয়াটে চাঁদের শিহরে আজ নেই কোনো অন্যতর চাঁদ, চোখে মরফির নেশা
রংবিরঙ্গি নিশি রমণীরা আদুল দেহে নেমে আসে ঘোড় দৌড়ের মাঠে 
মদ্যপ জুয়াড়ির শক্ত মুঠির থেকে খসে পড়ে সাতপুরোখিয়া ধনযৌবন। ......
নারীমাংস বিকি কিনির বাজার ও রন্ধন শালার পেছুয়াড়ি থেকে উঠে আসে ফেউয়ের অশুভ ডাক
বন্দরে এসে ভেড়ে দূরান্তের জাহাজ-নাবিকের মুখের ভদকা ও চুরুটের ধোঁয়ার গন্ধ কালপেঁচা বুঝে যায় ঠিক
তন্দুরিচুল্লির গর্ভে লাল শুকর ছানার সাথে ঝলসে সুস্বাদু হয় উঠে কুমারীর জরায়ু ছেঁড়া টসটসে ভ্রুণ ............. 

দধীচির হাড় 


গাছের পাতাদের ভেতর যে রোদ লুকিয়ে আছে এবং মর্মরতা - তার ভেতরে তুমি দীপঙ্কর। ....
খোলা বারান্দায় জানুপেতে আমি তোমাকে খুঁজি 
মাটিপোড়ার গন্ধ বাতাসে -হাহাকার সময় দীর্ণপাঁজর কাঁপিয়ে  যায় 
নিঃস্ব একক বনসাই জীবন নিয়ে আমি নত  হয় থাকি  - 
সম্মুখে সটান দাঁড়িয়ে থাকে আমাদের একছত্র পঁয়ত্রিশ বছর -
আমাদের একাত্ম জীবন যাপনের কথা দিল্লির কবিতাপণ্ডিতেরা জেনে ও  লিপিবদ্ধ করেনি কখনও 

মনেপড়ে শীত গ্রীষ্ম বর্ষা শরৎ হেমন্ত চৈত ফাগুন 
কবিতার ভুত মাথায় উলুঝুলু তীব্র তরল হাতে গোবিন্দপুরির জুসের দোকান 
চিত্তরঞ্জনের নিরিবিলি কালভার্ট , আরাবল্লীর টিলাপাথর  যমুনাতটের বৃস্তৃত ধুধুপ্রান্তর 
দিল্লিহাটের মহানিম , তপ্ত , হিম ,গ্রানাইট টেবিল 
স্নেহআদ্র মামিমার কিদয়াই নগর ,অন্নপূর্ণা  মাসিমার সি -১৮ কালকাজি ডিডিএ ফ্লাট 
শশাঙ্ক -দূর্গাদেবীর 'প্রাংশু ' মরুদ্যান ,আশীষের ট্যুর কর্নার -শম্ভুর বুকস্টল ,
বড়ুয়ার চায়ের দোকান তার্কিক ডি,কে,ডি'র  সেলুন 
কুয়াশায় ঢাকা ইন্ডিয়া গেট ,যন্তরমন্তর -মন্ডি হাউস ,ইন্দ্রপ্রস্থ ,শেরশাহের জীর্ণ সিংহদ্বার 
রাগ দুঃখ অভিমান -জোৎস্নার হারিকারি শিমুল সোঁদালের মাথায় মধ্যরাত্তিরে 
সময়ের হুঁস নেই ,কবিতায় মশগুল -মদ্যপ  আমাদের পেছনে 
আকস্মাৎ এসে থেমে যাওয়া পুলিশের বুটের শব্দ ,নিঃশব্দে ফিরে গেছে নিজের ঠিকানায় 

কবিতা কবিতা খেলতে খেলতে সময়ের ঘোলা স্রোতে হারিয়ে যাওয়া 
আমাদের কনকনে শীতের রাত ,আঁধি লাগা জ্যৈষ্ঠের দুপুর 
মৈত্রেয় -মহাশ্বেতা -নবারুণ -সন্দীপন -পৃত্থিশ -সমরেন্দ্র -শক্তি -সুনীল- 
তারাপদ -মীনাক্ষী -কবিতা -পূর্ণেন্দু -সমীরণ -অনিল -গৌরীশঙ্কর -দিব্যাংশু-
তমালিকা -ধূর্জটি -শ্যামল -মলয় -রবীন -বারীন -কমল -দেবী -করুণানিধান- 
যতিন -ভবেশ -করঞ্জিয়া-বিবেকানন্দ -বার্ণিক -বীরু -কানাইলাল 
জ্যোতিরিন্দ্র -ফণী -মণি -লোকনাথ-বৃজমাধব -ভবানী -আদিত্য -বিকাস -রবীন্দ্র 
দেবব্রত -শৈলেন -শর্বানীরঞ্জন -মণিরত্ন -মিহির -অরুণ -মনোজ -পীযুষ মু -
অরূপ -গৌতম -তড়িৎ -হিমাদ্রি -জালাল -জমিল -দিলীপ - বিশ্বজিৎ-সঞ্জীবন -প্রাণজি -পীযুষ বি -পুণ্যব্রত -
ভারতী -বনানী-দীপ্তি -রীনা-মিতালি -মেঘমালা -মালবিকা -সমপ্রভা -বেদবতী -শ্যামলী
সঙ্ঘমিত্রা -অদিতি -শঙ্করী -চৈতালী -গায়ত্রী -হেমা -তসলিমা -অপর্ণা -কৃষ্ণা -পৃথা -রিমা -জয়তি -স্বপ্না -ভাস্বতী 
সোনালী -নন্দিনী- অঞ্জলি -অজন্তা -দেবযানী-তনুশ্রী -ঈশিতা 

ওই-তো- বারাখাম্বা রোডে নিম অর্জুন বয়ড়ার ছায়ায় আনমনা রামকিঙ্কর বেঈজ 
ওই-তো -সাহিত্য আকাডেমির রিডিং রুমে গ্রন্থপাঠে নিমগ্ন শিশির কুমার দাস 
ওই-তো -পথনাটিকায় রক্তঘাম ঝরাতে ঝরাতে পথ হয় গেলেন সাফদার হাসমি 
ওই-তো-বের সরাইয়ের রহস্যময় আলো আঁধারিতে নতুন সৃষ্টিতে মগ্ন হাবিব তানবির 
ওই-তো- টিলা পাহাড়ের চূড়োয় বসে ,কালকা মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি শুনছেন মহাকবি  আমির খুসরু 
ওই-তো-দরিয়াগঞ্জের পথে উদাসিন হেঁটে যাচ্ছেন কবি দারাশুকহ 
ওই-তো -মাঝরাতে জুয়াখেলায় হেরে এক বুক গ্লানি নিয়ে চাঁদনী চকের পথে টলোমলো গালিব 
ওই-তো -তুঘলকি ফরমান খারিজ করে শিষ্যদের সাথে সুফী গানে মেতে উঠেছেন  খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়া 
ওই-তো -নাসিরুদ্দিন মেহমুদ চিরাগ দেহলবির আত্মার আলোয় এখনো উজ্বল হয়ে আছে ,গাঁও চিরাগ-ই-দিল্লি 

বুকের গভীরে বুজকুড়ি কাটতে থাকা আরো  কত স্থান  আরো কত মুখ আরো কত নাম 
আমার অভীশপ্ত  জীবনের চারপাশে ঘূর্ণায়মান উজ্জ্বল নক্ষত্র সব........ 
আজ তুমি নেই ,সমীরণ নেই, অনিল নেই ,দেবু নেই,
মিহির নেই, মনোজ নেই, শশাঙ্ক দূর্গাদেবীর মরূদ্যান  নেই , মঞ্জুলা দেবীর পরমান্ন নেই ,
নিঃস্ব আমি সেই সব মুখ আগলে দগ্ধবুকের ভেতর বোবাচোখে গাছের পাতাদের দেখি
আমি আর কবিতা লিখিনা দীপঙ্কর ! সারারাত জেগে থাকি তোমার কণ্ঠস্বর শোনার অপেক্ষায় 
ভূত পিশাচ দানবের সাথে অন্ধকার সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে আমি ক্রমশ স্বর্গ না নরকের দিকে, 
কে  বলে দেবে ? কে বলে দেবে ? কী  পরিচয় আমার এই সমাধি শহরে 
কী পরিচয় কলকাতার  হই হই  কবুতর বাজারে .....
দিল্লির ধুঁয়াধার পথে লাখটাকায় ঈদের খাসি নীলাম হয় 
মানুষের দাম নেই কানাকড়ি বেওয়ারিশ লাশ হয় পড়ে থাকে চৌরাহায় ,গন্ধা নালীতে 

তুঘলকি কিলা -আরাবল্লীর জঙ্গল কাঁপিয়ে প্লেন যায় কুতুবের দিকে 
নগ্ন বুকে দূরাগত আমলকি হাওয়া -শিরশিরানি অশ্বথ পাতার -
কদমফুল ফুটেউঠছে কোথায় চুপে  গহীন পুকুরের পাড়ে 
বহুদুরে খালপাড়ে স্বজনের চিতা জ্বলে.....
আদিগন্ত শস্যহীন প্রান্তরে অবিরত ঝিঁঝিরোব ঝিকিমিকি জোনাক,
তারাভরা আকাশ মাথায়  দ্রুতবেগে  হেঁটে যান অলৌকিক পুরুষ 
আমার কোনো দেশ নেই জাত নেই ধর্ম নেই লিঙ্গ নেই ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান নেই ,
কেবলই আত্মা এক কালস্রোতে মিশে যাওয়া প্ৰিয়তম আত্মাদের  খুঁজি ...........

No comments:

Post a Comment

Facebook Comments