দিলীপ ফৌজদার

কবিতা আলোচনায় দিল্লির তিন কবি।

পীযূষ বিশ্বাস ও মোনালি রায় দিলীপ ফৌজদারের কবিতা নিয়ে ছানবীন করছেন হোয়াটস্যাপে । 


দিলীপ ফৌজদার দিল্লির বাংলা কবিতার একটা অবিচ্ছেদ্য নাম । দিল্লি হাটার্স পত্রিকার  সম্পাদক । কবি, চিন্তাবিদ ও সমালোচক । বাংলা কবিতা জগতের ক্ষেত্রে দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে কবিতা লিখছেন। কবিতা সমালোচক - আলোচনা করেছেন অন্য কবিদের কবিতা । কবিতা নিয়ে নিজের চিন্তাভাব ব্যক্ত করেছেন নানান পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলি দিয়ে দিল্লির বন্ধুর ভূমিতে মালতী ফুটিয়ে তোলার কাজ করছেন । মিথিমপিথিম, মাকুমানুষ, বিষবাগীচায় ফুল ফুটে আছে, প্যাঁটরা এই সমস্ত কবিতা রচনা দিয়ে তাঁর কবিতার  নিজস্ব শব্দ ও চিন্তাসূত্রে, সমগ্র বাংলা সাহিত্যে নতুন সংযোজন করে চলেছেন ।  আপনার সাক্ষাতকার শূন্যকাল অতি সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করবে এবং একটা দলিল হয়ে দিল্লির সাহিত্য চর্চার সঙ্গে জড়িয়ে থাকবে । 

পীযূষ বিশ্বাস:  দিল্লিতে কিভাবে আপনার সাহিত্য জীবন শুরু হল ।
দিলীপ ফৌজদারঃ ১৯৮১তে দিল্লিতে পা রাখার পর এখানের বসবাস আরম্ভ হয়েছিল 'মসজিদ মোঠ' এলাকায়। জায়গাটাকে গ্রেটার কৈলাস -III বলেও অনেকে চিহ্নিত করতে চান। এটা জুড়ে আছে সাবিত্রী সিনেমা এলাকা, চিত্তরঞ্জন পার্ক, নেহরু প্রেস, কালকাজী ইত্যাদির সঙ্গে। সেসব  জায়গা এখন দেয়াল- গেটএর সুরক্ষার জেরে এতই দুরূহ যে একটা স্পট থেকে আরেক টায় পৌঁছানোর পথ খুঁজতে গেছোদাদার আঁক নিয়ে বসতে হয়। ১৯৮১-৮৫ সময়টায় এসব জায়গার ৫০% খোলা মাঠ ছিল।  রাস্তায় গাড়িচলাচলও অনেক কম ছিল। চিত্তরঞ্জন পার্কের সঙ্গে একটা স্বতঃস্ফূর্ত স্বরচিত সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। যেটার আকর্ষণ এটাই ছিল যে এখানে সকলেই বাংলায় কথা বলত। এখানে যদিও সম্পর্ক ছিল দোকানবাজার মিষ্টি বা মাছতরকারির ভেতরেই সীমিত। । দুর্গাপূজা নববর্ষের মেলা দেখা, দেয়ালে বাংলায় লেখা পোস্টার পড়া ছাড়া অন্য কোন ব্যাপার আসেনি কেননা কবিতার সঙ্গে সেসময় আমার বিচ্ছেদ ঘটে গেছিল মূলত যোগাযোগের অভাবে। তবু যেহেতু কবিতার সঙ্গে গাঁঠছড়া বাঁধা হয়েই গেছিল তাই চিত্তরঞ্জন পার্কের বিশেষ অনুষ্ঠানগুলোতে থাকতাম সম্পূর্ণভাবে পরিচয়হীনতাকে মেনেই। আমাকে ৪০ বছর ধরে বাংলা কবিতার সঙ্গে জুড়ে দেওয়াটাতে  এই inaccuracyটা থেকেই যাবে যে মাঝের কিছু বছর, ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৮, আমার কবিতা কোথাও প্রকাশিত হয় নি। 

আমরা ছিলাম কৃত্তিবাসএর পরবর্তীকালের। আমাদের তখন একটা উন্মাদনাই ছিল কৃত্তিবাসদের কবিতার ভাষা ও মতামতকে চেনা। অনেক সামাজিক নিয়মকানুন কে ভাঙার বা লাইফস্টাইল ও অ্যাটিচ্যুড বদলে দেওয়ার  কথা কৃত্তিবাসের কবিরা বলতেন সে সময়।

১৯৯৮ সালে প্রায় ২৪ বছর পর এই দিল্লিতেই কবিতায় ফিরে এসেছি। ‘উন্মুক্ত উচ্ছ্বাস’ পত্রিকার সম্পাদক বিকাশ বিশ্বাস এই দিল্লিরই একটা ঘরোয়া আড্ডায় আমার কবিতা শুনে আমাকে ‘উন্মুক্ত উচ্ছ্বাস’ পত্রিকার খবর দেন ও তাতে লিখতেও বলেন। পরে একদিন চিত্তরঞ্জন পার্কের এক সভাতে জানলাম ‘উন্মুক্ত উচ্ছ্বাস’ পত্রিকার আগামী সংখ্যায় আমার কবিতাটি আসছে। এর পর আলাপ অরূপ চৌধুরীর সঙ্গে যিনি আমাকে এই কথা বলে অবাক করে দেন যে তিনি কবি হিসেবেই আমাকে চেনেন ৭০এর দশক থেকেই এবং তিনি মিহির রায়চৌধুরিকেও চেনেন। এই সূত্রেই দিল্লি হাটের আড্ডায় আমার জায়গা হয়।

পীযূষ বিশ্বাসঃ আপনার পৈত্রিক ভিটার কথা কি কবিতাকে প্রভাবিত করে ?
দিলীপ ফৌজদারঃ আমার পৈতৃক ভিটার অনেক ছোট বড় কথাবার্তা এসে যায় আমার কবিতায়। কবিতা ও নিয়ে ঘর করে বলা যায় - প্রভাব বলা যায় কি? কবিতায় প্রভাব বলতে আমি বুঝি ভাষা চয়ন, আঙ্গিক, কথনভঙ্গি। এতে কখন কার প্রভাব এসে যায় কি করে বলব? অনেকের মতো নিজের কোন ধারা প্রবর্তনের চেষ্টায় কখনো থাকি নি এতটা বলতে পারি। কবিতায় আসার পেছনে গোড়া থেকেই যেটা চালক হয়েছিল তা অভিব্যক্তি। "ধর্মাবতার, আমি কিছু বলতে চাই।" এটাই চালিয়ে এসেছে কারণ আমি আগাগোড়া মনে কবে এসেছি যে আমার কিছু সঙ্গত বক্তব্য আছে কবিতায়। এর পরে ঐ কথাটাও আসে "যাহা বলিব সত্য বলিব"। আমি বিশ্বাস করি ঐ সত্যর রাস্তা ধরে ধরেই সবকিছু আসে। নতুন সময়, নতুন ভাষা, নতুন বিষয়। 

পীযূষ বিশ্বাসঃ মিথিমপিথিম আপনার গুরুত্বপূর্ণ কাব্যগ্রন্থ । মিথিমপিথিমের পটভূমিকা কি ?
দিলীপ ফৌজদারঃ মিথিমপিথিম লেখার সময়টায় অনেক কিছু ঘটে গেছিল। মিথিমপিথিমএর প্রকাশকাল 2009।  2005 এ স্বজনবিযোগ ও সংসারে অসুস্থতা নিয়ে ভোগান্তি চলছিল আমার। ঐ অবস্থাতেই  দিল্লিতে ঘরসংসার ফেলে আমি বাস করছিলাম ব্যাঙ্গালোরে। 2005 সালেই দীপঙ্করের মাতৃবিয়োগ হয়। এই ঘটনার পর দীপঙ্কর তার কবি বন্ধুদের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। 2008 এ আমার স্ত্রীও দীর্ঘ দিন রোগভোগের পর মারা যায়। এই সময়টায় আমি ও দীপঙ্কর নানা কারণে হরিদ্বার-হৃষীকেশ গেলাম বেশ কয়েকবার। সেসবের প্রভাব পড়েছিল মিথিমপিথিমএর কবিতাগুলিতে। এতে বেশ কয়েকটি পরাবাস্তব কবিতা আছে।

পীযূষ বিশ্বাসঃ
বিষ বাগিচায় ফুল ফুটে আছে কাব্যগ্রন্থে কি পোস্টমডার্ন ধরার চেষ্টা আছে ?
দিলীপ ফৌজদারঃ না। পোস্টমডার্ণ পর্ব মাকুমানুষেই সীমিত ছিল।  মিথিমপিথিমএ আমি নিজের ধারায় চলে এসেছি। আমার নিজস্ব জগতে কবিতা ধরার ব্যাপারে ক্যানভাসে ছবি আঁকতে না পারার মানসিক অভাববোধটা কাজ করে। আমি অনেককাল ধরেই দৈনন্দিনতার বিমূর্ত ও পরাবাস্তব ছবিগুলিকে কবিতায় আনতে চেষ্টা করি।

পীযূষ বিশ্বাসঃ প্যাঁটরা বইটি লেখার সময় কবিতায় আপনি কোথায় পৌছাতে চেয়েছিলেন ?
দিলীপ ফৌজদারঃ সরলতায় এবং মৌলিকতায়। প্যাঁটরা তে স্মৃতি বা স্মরণ নিয়ে একটা ট্রিটমেন্ট আছে। কবিতা গুলির ভেতরেই স্মৃতি বিষয়ক একটি ভাবনা চলমান আর স্মৃতির ব্যক্তিগত বোধে একটা নিরাসক্ত অভিব্যক্তিকে জাগিয়ে রাখা হয়েছে।


মোনালী রায়ঃ ছবির সাথে কবিতা নিয়ে মিশ্র কাজ হচ্ছে, ওই জাতীয় কাজ করার ইচ্ছে আপনার আছে?
দিলীপ ফৌজদারঃ আমি নিজের দেখা থেকে জানি আঁকা ছবিই কবিতার সব চাইতে নিকট আত্মীয়। অনেকে ভাবেন ওটা সঙ্গীত। কেননা মার্গসঙ্গীতের পরিবেশনায় যে বিমূর্ত ভাব থাকে তার সঙ্গে কবিতার আত্মার মেলমেলাপ চোখে না পড়ার কোন অবকাশ নেই। বাংলা কবিতার পাঠক রবীন্দ্রসঙ্গীতের আশ্রয় নেবেন এটা বোঝাতে যে সঙ্গীতেরই সবচাইতে বেশি মিল কবিতার সঙ্গে আমার মনে হয়েছে রবীন্দ্রনাথের  শ্রেষ্ঠ লিরিকগুলি অতি উন্নত মানের কবিতা হওয়া সত্ত্বেও ওগুলি গানের পথ ধরেই মানুষকে আনন্দ দিয়েছে। ওগুলো গান বলেই সুন্দর। এই রবীন্দ্রনাথেরই উদাহরণ নেওয়া যায় এটা দেখাতে যে কবিতার সৌন্দর্য বা কবিতার আনন্দের সঙ্গে তুলনীয় রংতুলির ছবি দেখার নান্দনিক অভিজ্ঞতাই। কবিতা কিভাবে চিত্রকলার সঙ্গে তুলনীয় সেটা রবীন্দ্রনাথের কাজ থেকেই আমরা বুঝি। বার্ধক্যের মুখোমুখি দাঁডিয়ে রং তুলি হাতে তুলে নিয়েছিলেন।  শিক্ষণ বলতে ছিল কবিতা লেখার কলাকৌশল। তারই জেরে চিত্রকলা। যে খেলাটা খেলছিলেন  শব্দ দিয়ে সেটাই তখন রং দিয়ে। আবার দেখি রংদের পাশাপাশি অবস্থান থেকেই দেখতে পেয়েছিলেন কবিতা। "আজ সবার রঙে রং মেশাতে হবে" এর বিমূর্ত ঈপ্সাতেও ছবি কিংবা "চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে" এই দেখার পরাবাস্তবতায় আলোর ভূমিকা এগুলি কথা বা শব্দ দিয়ে ছবি ফোটানো – আর অবশ্যই, কথাটা শুধু এটুকুতেই সীমিত নয়। 

আমরা একবার ভেবেছিলাম একটা exhibition করব তাতে কবিদের এক একটা কবিতার সঙ্গে এক একটা চিত্রণ থাকবে ক্যানভাসে।  সাধ ছিল সাধ্য ছিল না। এমন অবস্থার কারণ যে, যে কবিরা এতে সম্মত ছিলেন তাঁদের কারোরই, আমি সহ, কাঠ খড় যোগাড়ের তৎপরতা বা মানসিকতা কোনটাই ছিল না।


পীযূষ বিশ্বাসঃ দিল্লি হাটার্স পত্রিকায় কি ভাবে এলেন ? এটা আপনার প্রথম সম্পাদক হিসাবে যাত্রা ?
দিলীপ ফৌজদারঃ এ সম্পর্কে আগে যা লিখেছি তা থেকেই তুলে দিচ্ছি ।
1999 থেকেই অরূপ চৌধুরী, দীপঙ্কর দত্ত সহ কবিতায় কিছু উৎসাহী জন, সকলেই যে কবি ছিলেন, তা নয়, এঁরা দিল্লি হাট এ আড্ডা দিতেন কবি, গদ্যকার রবীন্দ্র গুহর সঙ্গে। তখনো পর্যন্ত এই আড্ডা তেমন জমে ওঠে নি। রবীন্দ্র গুহর  আগ্রহ ছিল নতুন ধরনের লেখা, সাহিত্যে নতুনত্ব আনার । তাঁর বিশেষ আকর্ষণ ছিল দীপঙ্কর দত্তর মত রাডিক্যাল কবির সঙ্গলাভ। এই  আবেগের টানেই আড্ডা ক্রমশ দানা বাঁধতে শুরু করল। আমি এলাম অরূপের তাগিদে সাল 2000 এর আরম্ভেই সেই সঙ্গেই গৌতম দাশগুপ্ত। এর পর এলেন কৃষ্ণা মিশ্র ভট্টাচার্য, প্রাণ জি বসাক, প্রশান্ত বারিক ও মিহির রায়চৌধুরী। 2001 সাল থেকেই আড্ডাটি নিয়মিত হতে আরম্ভ করল। এই বছরই বারীন ঘোষালও এতে নিয়মিত আসা শুরু করলেন।

পীযূষ বিশ্বাসঃ দিল্লি হাটার্স পত্রিকার নামকরণ কি ভাবে এলো ।
দিলীপ ফৌজদারঃ আমরা দিল্লি হাটে বসা আরম্ভ করি ১৯৯৯ এর থেকেই। দিল্লি হাটার্স পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশ পায় ২০০৩ সালে। ২০০০ সালেরই গ্রীষ্মে কৌরব এর কবি বারীন ঘোষালের সম্পর্ক জুড়ে গেল আমাদের সঙ্গে। এটা হতে হতেই খুব সহজেই ও অতি অল্প সময়েই বারীন আমাদের আপনজন হয়ে গেলেন। ক্রমশ জানলাম আমাদের মতই তিনি আরও অনেক কবিগোষ্ঠির সঙ্গে মেলামেশা করতেন। দিল্লির কবিরা বসত দিল্লি হাটের কংক্রীট চাতালে। বারীনের ভাল লাগত জমাট এই কবিআড্ডা। ফিরে গিয়ে চিঠি লিখতেন দিল্লি হাটার্সরা কেমন আছে? ছেলে (শুক) পড়াশুনা করছিল দিল্লিতে। বারীন বছরে দুবার অন্তত থাকতেনই বেশ কিছুদিনের জন্য। এই ছিল বারীন ঘোষালের দিল্লি এবং দিল্লী হাটে কবিদের আড্ডার সঙ্গে সম্পর্কের ইতিবৃত্ত। 2003 সালে “দিল্লি হাটার্স” পত্রিকা নিয়ে জল্পনাকল্পনা চলছিল দিল্লী হাটে। পত্রিকার নাম কি রাখা হবে? তখন বারীনের দেওয়া ঐ নামটিকে আর কোন নাম অতিক্রম করতে পারল না।

পীযূষ বিশ্বাসঃ দিল্লি সাহিত্যে উন্মুক্ত উচ্ছাস বা দিগঙ্গন পত্রিকা থাকা সত্তেও দিল্লি হাটার্স  কেন ?
দিলীপ ফৌজদারঃ 2003 থেকেই এই প্রশ্নটা উঠেছিল। বারীন ঘোষাল, অজিত রায়, সম্ভবত সুকুমার চৌধুরীও এই প্রশ্নটা তোলেন যে আরেকটা পত্রিকা কেন? সম্ভবত এই প্রশ্নের পরিসরে উল্লিখিত দিল্লির পত্রিকাগুলির কথা তাঁরা ভাবেন নি।। কলকাতার বন্ধুরা,  অলোক বিশ্বাস, প্রণব পাল এঁরা খোলাখুলি ওয়েলকাম জানিয়েছিলেন। আমি এসময় এতখানি সদরে ছিলাম না। যদিও সম্পাদক হিসেবে আমাকেই ভাবা হয়েছিল।

পীযূষ বিশ্বাসঃ দিল্লি হাটার্স গ্রুপের মেম্বার সংখ্যা কত ? কলকাতা, ঢাকা , শিলিগুড়ি বা আগরতলায় এর পাঠক আছে ?
দিলীপ ফৌজদারঃ এগুলির হিসাবনিকাশ করা হয় নি। পাঠক আছে যেটা নানা ধরণের যোগাযোগমাধ্যম থেকে বোঝা গেছে বিগত 13 বছরে। কোন রেকর্ড রাখার মত সংগঠন দিল্লি হাটার্সএর ছিল না কোনদিনই।
প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তেই বলা হয়েছিল যে যিনিই এসে বসবেন দিল্লি হাটের পাথরচাতালের আড্ডায় তিনিই দিল্লি হাটার্স।

পীযূষ বিশ্বাসঃ ডায়াস্পোরা সাহিত্য নিয়ে আপনার কি ধারনা ?
দিলীপ ফৌজদারঃ ডায়াস্পোরা সাহিত্য তো আছেই এটা খুব ভালো ফুটে ওঠার স্কোপ সম্ভবত হিন্দি সিনেমাতে যেখানে এর ঢালাও ইস্তেমাল হয় ।- বাজারের কথা ভেবে বলছি। স্থানিকতার প্রশ্নটিই এখানে মূল কথা। সিনেমা বা নাটকে এটি সহজ স্বাভাবিক ভাবেই চলে আসে। গদ্য লেখাতেও স্থানিকতার প্রতিফলন যথেষ্টভাবে দেখা গেছে। সতীনাথ ভাদুড়ী, বনফুল এঁরা খুব সার্থকভাবে ডায়াসপোরা সাহিত্য করে গেছেন। খ্যাতির কথা বললে এঁদের আমরা কোনদিনই বুদ্ধদেব বসু বা তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের সমকক্ষ হিসেবে পাব না।

পীযূষ বিশ্বাসঃ রবীন্দ্র গুহের সঙ্গে আপনি অনেকদিন সাহিত্য আসর করেছেন । তার সঙ্গে কাজ করার কি অভিজ্ঞতা ?  নিম সাহিত্য নিয়ে আপনার কি ধারনা ?  
দিলীপ ফৌজদারঃ কবিতা বা সাহিত্য আন্দোলনকে আমি রাজনৈতিক আন্দোলনগুলির তুলনীয় বলে কখনই ভাবি না। রবীন্দ্র গুহ বা দীপঙ্কর দত্ত এঁরা দুজনেই সাহিত্য বা কবিতার ক্ষেত্রে মৌলিক চিন্তার অধিকারী কিন্তু কবিতা দিয়ে চিন্তাকে প্রভাবিত করার জায়গাটা সৃষ্টি। আন্দোলন নয়।

পীযূষ বিশ্বাসঃ দিল্লি হাটার্সের ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনার অভিমত ? পত্রিকাটি কি বন্ধ হয়ে যেতে চলেছে ?
দিলীপ ফৌজদারঃ না। বন্ধ হবে না। কেউ এসে এটা চালাবে। অন্য নামেও চলতে পারে ভবিষ্যতে। মূল কথাটা 'দিল্লি হাটার্স' নয়। মূল জায়গাটায় আছে দিল্লি এবং তার বাংলা বচন সেটা মরবে না। আমরা সলতেটাকে উশকে রেখেছি এতকাল। চিরদিন তো থাকব না। তাহলে প্রতিষ্ঠানকে মেনে নিতে হবে। সাহিত্য বা শিল্পকলা কোন প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে পারে না। প্রতিষ্ঠান নামক বস্তুটি সৃষ্টির বিপরীত মেরুতে বাস করে। আবার, প্রতিষ্ঠান না থাকলে কোন কিছু টেকেও তো না। 'দিল্লি হাটার্স'এও তো আমাদের এই অভিজ্ঞতাটাই হচ্ছে।

পীযূষ বিশ্বাসঃ আপনার পরবর্তী প্রোজেক্ট কি ? কোন নতুন বই বের হতে চলেছে কি ?    
দিলীপ ফৌজদারঃ নতুন বই আসছেই। তবে কবে যে সেটা আসবে সে এক প্রহেলিকা।

পীযূষ বিশ্বাসঃ স্থানিকতা নিয়ে কিছু বলুন । সাহিত্যে কি ভৌগলিক বলে কিছু আছে ?
দিলীপ ফৌজদারঃ স্থানিকতা নানাভাবে প্রকাশ পায়। এতে স্থান এর সঙ্গে কাল জুড়ে গিয়ে ঐখানেই ওটা বহুমাত্রিক হয়ে যায় । এর ওপরে ছাপ ফেলতে পারে কিছু ঘটন যেগুলি চিহ্নিত। সংবাদ মিডিয়া সোস্যাল মিডিয়া সকলে মিলেই এই চিহ্নিতকরনের কাজটি করেন। এই পদ্ধতিক্রমেই ইতিহাস। স্থানিকতার অভিব্যক্তি ইতিহাসের চিহ্নগুলি ধরেও আসতে পারে - ভৌগলিক চিহ্নগুলি তো এমনভাবে থাকে যেটা স্থানের সঙ্গে ভিন্নমতর  কাল দুটোতেই একসাথে নিয়ে আসতে পারে কবিতায় ।

"রোদ খুব চড়া হলে দিল্লির লেবার্ণামে লেবার্ণামে উৎসব চুয়াল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াসে" ঃ ‘জয় হো’, মিথিমপিথিম
মেয়েগুলো মাঝরাতে বাড়ী ফেরে ¬¬__ সৌম্যা বা জিগীষা যে নামেরই হোক
না। এখনো কিছু প্রাচীন মানুষ জীবিত আছে পোক্ত সূতোর_
আস্থায় ইলোরা থাম, কোনদিন এদেরই বুক হাতুড়িতে ভেঙে যায়
গাড়ীগুলোর খোল রাস্তায় ফেলে দেওয়া__ মেয়েগুলো মর্গে
                        ‘আছি না আছি ঃমিথিমপিথিম     
মিথিমপিথিমএ আরো কিছু কবিতায় দিল্লির স্থানিকতা ধরা আছে ভিন্ন ভিন্ন রকমে যেমন: "রাভিন গুহার সঙ্গে মেট্রো ট্রেনে বাড়ী" বা "বেঁচে থাকো সর্দি কাশি"।


মোনালী রায়ঃ সময় বা কাল নিয়ে আপনার কয়েকটি কবিতা আছে, সময় বা কাল সম্বন্ধে এবং সময় ও স্থানের আপেক্ষিকতা বিষয়ে কিছু যদি বলেন
দিলীপ ফৌজদারঃ জানিনা। মনে হয় শুধু সময় ও স্থানের আপেক্ষিকতা দিয়ে কথাটা শেষ হয় না। যেন একটা স্ট্রিং থিওরি কাজ করে কোথাও। মনে হয় সব কবিতাকেই স্থাপন করা হয় কো-অর্ডিনেটদের দিয়ে। বিমূর্ত (অ্যাবস্ট্র্যাক্ট) কবিতা বা পরাবাস্তব (surrealist) কবিতাও এর বাইরেকার নয়।
যে বিনির্মাণএর কথা বাংলা কবিতার এরেনাতে আলোচিত হয়েছে বহুল অবস্থায সেও একটা ফ্রেমের ভেতরেই ঘটে। 
এবার সময়ের নিজস্ব কিছু কথা: specifics of time;
একটা তো পরিস্থিতি। এর বেশিটাই আমার নিজেরই সৃষ্টি। যে পরিস্থিতিতে নিজেকে স্থাপন করেছি সেটা আমারই কৃতকর্ম। এখানে চয়নের কথাটা আসে যেটার খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া যায় বলে আমি মনে করি না। জীবনটা স্বয়ংবরসভা নয়। আমার মনে একটা গণিত আছে এখানে, যেটার অল্প কিছুটাই যুক্তিবাদীদের আওতার। বাকীটা জানাশোনা যুক্তিতে আঁটে না।  কবিতার প্রসঙ্গে এটা বিষয় নয় কিন্তু যেটুকু প্রাসঙ্গিক তা হোল আমার জগতকে, জীবনকে দেখতে চিনতে যে মন লাগে তার সীমাপরিসীমা নেই, কোন বাঁধাধরা সূত্র নেই। এর অনেক সূত্র আবিষ্কৃত, উন্মোচিত হওয়ার পরও তারা যে সমুদ্রে তলিয়েছে সেটাও কাল, সময়। যেখানে গণিত থেকেও নেই।

“এত ভিন্নমুখি ক্ষণগুলি একপাতে বসে সময় ভক্ষণ করে।
সময় সে এমনিই ভেজাবেরাল, মেনিমুখো, বেশিক্ষণ খুলে রাখে না
বোধের জানালা।  অজান্তে কখন, কেউ কিছু নাড়ায় নি
তাও, উটকো শব্দে, উড়ন্ত ধুলোর এই পতপতে পাল্লাগুলি
লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যায় সব বোঝাপড়া” মিথিমপিথিম

পীযূষ বিশ্বাসঃ আপনি কি মনে করেন বারীন ঘোষাল প্রবর্তিত নতুন কবিতার সঙ্গে আপনাদের কবিতার কোন কমোন লিঙ্ক আছে ?
দিলীপ ফৌজদারঃ আমার মনে হয় না আছে বলে।  আমাদের আড্ডায় প্রথম থেকেই রবীন্দ্র গুহ স্থানিকতার প্রশ্নটি তুলেছিলেন। তাঁর কাব্য বা গদ্যভাষায় স্থানিকতার তীব্র উপস্থিতি আমরা দেখেছি। এই স্থানিকতার কথাটি আমাদের মনে ধরেছিল । দিল্লি হাটার্সের কবিদের ওপর এই কথার প্রভাব অবশ্যই ছিল কিন্ত সকলেই কথাটি নিয়েছিল নিজের মতন করে।

পীযূষ বিশ্বাসঃ ভাষা কে আপনি কতটা গুরুত্ব দেন ? দিল্লির কোন ভাষা নিয়ে কোন কাজ করেছেন ? সাহিত্যের কোন স্থানিকতা আছে কি? আপনার কি মতামত ?
দিলীপ ফৌজদারঃ এ ধরণের কাজ একমাত্র রবীন্দ্র গুহই করেছেন। অন্যরা ক্বচিৎই সংকরায়িত ভাষা বা স্থানীয় বুলি যেমন হরিয়াণা, রাজস্থান কিংবা মথুরা বা বুন্দেলখণ্ডের আঞ্চলিক ভাষাকে বাংলার সঙ্গে মিশ খাইয়েছেন। কিন্তু স্থানিকতা এসেছে অন্যদের লেখাতেও।  প্রত্যেকের অভিব্যক্তি ভিন্ন ভিন্ন ভাবে এসেছেঃ


পীযূষ বিশ্বাসঃ দিল্লিতে বর্তমানে কি রকম বাংলা সাহিত্য চর্চা রয়েছে ?  
দিলীপ ফৌজদারঃ সাহিত্য চর্চার যে বিশেষ জায়গাটি যেটি সৃজনের। আমার ধারণায়, সেটি দিল্লিতে জাগ্রত, দৃশ্য না হলেও।

পীযূষ বিশ্বাসঃ
কবি দীপংকর দত্তের সঙ্গে আপনার দীর্ঘদিনের ওঠাবসা ।  একঃ পাওয়ার পোয়েট্রির সঙ্গে কি আপনি একমত ছিলেন ? দুইঃ  কবি হিসাবে কবি দীপংকর দত্তের  কি সঠিক মূল্যায়ন হয়েছে ? 
দিলীপ ফৌজদারঃ পাওয়ার পোয়েট্রির উচ্চরব ছাড়া আর কোন কিছুকেই আমার বিশেষ বা আউটস্ট্যাণ্ডিং মনে হয় নি। এর একটা বিশেষ কারণ কবিতাগুলি পরিচিত ছিল। মলয় রায়-চৌধুরীর ভূমিকাটি উঁচু স্বরের কবিতাগুলির উপযুক্ত হয়েছিল বলে মনে হয়। 
মূল্যায়ন হয়েছে কবিতা বোদ্ধারা পড়েছেন এবং দুহাত তুলে প্রশংসা করেছেন। আমি ২০০৪ সালেই ওর কবিতার বিশেষত্ব নিয়ে আলোচনা করেছি।

মোনালী রায়ঃ শুনেছি, কবি দীপংকর দত্ত,  এক সময় তাঁর নিজের সব কবিতা, কিচ্ছু হয়নি বলে ফেলে দিয়েছিলেন, তিনি নিজেই নিজের কবিতার ওপর অবিচার করেছিলেন, বলে কি আপনার মনে হয়?
দিলীপ ফৌজদারঃ এটা সত্যি যে দীপঙ্কর তার লেখাপত্র জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল। এটা হয়েছিল 2005 সালে ওর মা গত হবার ঠিক পরে পরেই। অবিচার কথাটা সম্ভবত ঠিক নয। নিজের পছন্দ মত  না হওয়া পর্যন্ত ওর কবিতা জনসমক্ষে আসত না। কিচ্ছু হয় নি বলে ফেলে দিয়েছিল কি? মাতৃশোকের depression এর কারণে ফেলে দিয়েছিল সেটা আমরা ওর ঘনিষ্ঠ কয়েকজন শুনেছি ওর মুখ থেকেই। তবে এই ঘটনার অন্য কোন সাক্ষ্য নেই। আমরা জানি এবং দেখেওছি, দীপঙ্করের মা গত হবার ঠিক পর সে মানসিকভাবে অত্যন্তই ভেঙে পড়ে। বলতে গেলে আপনজন বলতে তখন ওর আর কেউই ছিল না।

মোনালী রায়ঃ দিল্লি হাটার্স এর জন্য দিল্লির নতুন কবিদের কিছু দায়িত্ব থাকা উচিৎ নয় কী?
দিলীপ ফৌজদারঃদায়িত্বটা হোল অনাগত কাল কে তুলে আনা। দিল্লি হাটার্স কে আমরা একটা সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভাবি নি গোড়া থেকেই। বলেছিলাম একটা প্লাটফর্ম হবে। তাই হয়েছিল। অনেক কবি এর থেকে বেরিয়ে গেছেন, রুজিরোজগারের তাগিদে, বার্ধক্যের  কোপ এড়াতে না পেরে।  নিজেকে আরো বড় কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার উচ্চাকাঙ্ক্ষায়। তার থেকেও বেশিরা গেছেন ইহজগত থেকে বিদায নেবার বাধ্যতার কারণে।

পীযূষ বিশ্বাসঃ  আপনিও তো কলকাতার অনেক পত্রিকায় লেখেন । সেই পত্রিকাগুলো সম্পর্কে যদি বলেন । কাদের সম্পর্কে আপনার ওঠা বসা ? কলকাতার সাহিত্য আর দিল্লির সাহিত্য কি আলাদা করা যায় ?
দিলীপ ফৌজদারঃ ওঠা বসা বলতে? কারো কাছে দীক্ষা নিই নি। ওঠা বসা দিল্লি হাটার্সদেরই সঙ্গে। একসঙ্গে থাকলে একে অপরের কাছ থেকে কিছু লেনদেন তো হয়ই। যে পত্রিকাগুলিতে লিখি, একা কলকাতার নয়, সেগুলি নিয়ে লেখাটা নিজেই একটা বিষয়। এখানে আনলে আমাদের আলোচনার প্রসঙ্গটা বদলে যাবে। কলকাতার সাহিত্য আর দিল্লির সাহিত্য আলাদা কেন হবে? দুটোই বাংলা সাহিত্য। ত্রিপুরা, গৌহাটি, লখনৌ, বারাণসী, কানপুর, নাগপুর বা পটনাতেও বাংলা সাহিত্য হয়। 

মোনালী রায়ঃ কবিতা কি? কবিতায় আগে ইজিম বা 'বাদ ' আসে নাকি কবিতা লেখার পর তাকে বিভিন্ন ইজম বা বাদ অনুযায়ী ভাগ করা হয়? 
দিলীপ ফৌজদারঃবিষয়টা নিয়ে চিন্তাশীলেরা অনেক ভাবনাচিন্তা করেছেন আবহমান সময়ে। সে সবের পরিক্রমা পেরিয়ে এখন দেখছি ওখানে এখনো অনেক কিছু বাকী থেকে আছে। বন্ধু প্রণব চক্রবর্তী, ইনটারাকশন পত্রিকার সম্পাদক, আমার কবিতাচিন্তার প্রবন্ধগুলি নিয়ে একটি বই করতে চান। হতে পারে পরবর্তী বইমেলা পর্যন্ত বইটি বেরিয়ে যাবে। এর ৪/৫টি লেখা  ইনটারাকশন পত্রিকাতেই বেরিয়েছিল।


ধন্যবাদ কবি, চিন্তাবিদ ও সাহিত্য সমালোচক দিলীপ ফৌজদার । আগামী প্রোজেক্টের অপেক্ষায় রইলাম । আজ এই পর্যন্তই আলোচনা রইল। পরবর্তীতে আমরা আবার নতুন কোন আলোচনায় নতুন কিছুর সন্ধান করবো । শূন্যকালের পক্ষ থেকে আবার ধন্যবাদ ।
 

1 comment:

Facebook Comments