রবীন্দ্র গুহ




আমার উড়োমানুষ-বন্ধু উহারা তাহারা - ২

রবীন্দ্র গুহ


এক সময় কলকাতার নাদু মসি-হস্তীরা হুটপাট চলে আসত শহর দিল্লিতে ।  'জিরো আওয়ারের' গৌতম-দীপঙ্করেরা বলতো: মৌচুষকি এসেছে হে । খুব জমেগা চিত্তরঞ্জন পার্কে পদলেহন । সুনীল গাঙ্গুলীর তো দুটোই খাস ডেসটিনেশন ছিল - ঢাকা আর শাহি দিল্লি । শেষের দিকে সুউদরটি থলথলে হয়ে গিয়েছিলো । সাহিত্যের কথা কম বলতো । বহুজাতিক পণ্য ও নিজের জন্ম ভিটার কথা বেশী বলত। সুনীলের আসরে তারাদের উপস্থিতির মধ্যে থাকতো হিমাদ্রি দত্ত, অরুণ চক্রবর্তী , বটকৃষ্ণ,ক্বচিৎ কখনো চাণক্য সেন । মৌরি থেকে তৈরি করা মদ পছন্দ সুনীলের । সেন্ট্রাল ম্যল্‌ থেকে নিয়ে আসতো হিমাদ্রি । ঘ্যাম্‌ পারসোনালিটি ছিল চাণক্য সেনের , কিন্তু সুনীলের আসরে মলিনমুখে বসে থাকতেন । মুখে টু শব্দটি নেই । চাণক্য সেন একদিন একত্রে পানাহারের জন্য নিমন্ত্রণ করেছিলেন । তার আগে চাণক্য সেন নিয়ে আমি একটি দীর্ঘ রচনা লিখি: "অদ্বিতীয় চাণক্য সেন ও পুত্র পিতাকে "। লেখাটি প্রকাশিত হয় বিকাশ বিশ্বাসের উন্মুক্ত উচ্ছ্বাসে । সে লেখা পড়ে চাণক্য সেন চোখে জল  নিয়ে বলেছিলেন , আপনাকে লোকে 'দ্রোহপুরুষ' বলে আখ্যায়িত করে - কথাটা ঠিকই । আমাকে নিয়ে লেখাটায় যথার্থ সাহস দেখিয়েছেন । দিল্লির কেউ আমাকে পছন্দ করে না । খুব ধিক্কার দেয় । কলকাতাকে তোয়াক্কা না করে আমি লেখালেখি করি ।
"আমি আপনার লেখা পছন্দ করি । আপনার লেখা বাজারু লেখা নয় , জয়নগরের মোয়া - পাটালি নয় । সর্বটাই অবিকৃত অভিজ্ঞতার ফসল।"

'আপনি আমাকে নিয়ে আরও লিখুন প্লিজ , আমার আইডেন্টিটি ক্রাইসিস- নিঃসঙ্গতা- ডায়াস্পোরিক আটিচুড----"

"বেশ লিখবো । কিন্তু সব ব্যাপারে আপনাকে আরও তেজি হতে হবে - আরও স্বয়ংক্রিয় , গতিশীল- । আপনি আকাদেমির জন্য সুনীলকে তিনপাতার চিঠি লিখেছিলেন । কেন ? সে চিঠি সুনীল বন্ধুদের দেখিয়েছে । হেসেছে  । মস্করা করেছে । আমি জানি কেউ ওরা 'রাজপথ জনপথ' পড়েনি , 'মুখ্যমন্ত্রী' পড়েনি', পড়লেও একবর্ণও বোঝেনি 'পুত্র পিতার আকাঙ্ক্ষা, দ্বন্দ্ব, বুকের ভূকম্পন, কতটা হীনতা ও সংকট সৃষ্টি করে - পরোক্ষে ও প্রত্যক্ষে । আমি জানি আপনার ভাবনা চিন্তার প্যাটার্ন কত গভীর - কতটা স্বতন্ত্র " ।

হ্যাঁ চাণক্য সেন তার আইডেন্টিটি তৈরি করতে পারেন নি  দিল্লির মসীহা হয়েও । কেননা তিনি Tale - Tell বৃত্তগল্প, গোল গল্প, ত্রিভূজ গল্প লেখেন নি । তিনি তুড়কমেজাজী ছিলেন না - সুনীলের মত , বিমল করের মত, শীর্ষেন্দু মুখোর মত নয় । তিনি বলেন নি - "হিন্দু ধরম ঝুটা হ্যাঁয়" । কবি বিনয় মজুমদারের মত বাংলা বাজারে তার অনেক শত্রু ছিল । দিল্লির শিশির কুমার দাশ সম্প্রদায় সুযোগ পেলেই ভাষাশব্দ নিয়ে তাকে নাস্তানাবুদ করত । এই রকম যখন পরিস্থিতি, আমি তখন লিখলামঃ কথাশিল্পী তিনিই যিনি কথা সচেতন । বর্ণবাদ সচেতন । চারিদিকের অস্থিরতার মধ্যে কোথায় আছে স্থিরতা তা জানা আছে যাঁর । প্রত্যেক দেশেই সৎ-সাহিত্য বিচারের জন্য একটি স্থায়ী অদৃশ্য পিপলস , ইউনিভার্সিটি আছে । আমাদের দেশেও আছে  । এই পিপলস , ইউনিভার্সিটি কোন লেখকের নামের আগে কথাশিল্পী উপাধিটি যুক্ত করে দেন । এর জন্য কোন উৎসব সমারোহের প্রয়োজন হইয় না । সবার অজ্ঞাতে আকস্মিক ভাবে ব্যাপারটা ঘটে । যেমন ঘটেছে কথাশিল্পী চাণক্য সেনের ক্ষত্রে । দিল্লির বাংলা বাজারে তুমুল হইচই হল । দিলীপ, দীপঙ্কর-গৌতম আমার পক্ষ নিলো । 'পুত্র পিতাকে' এবং 'ধীরে বহে নীল' তাদের অসাধারণ বলে মনে হয়েছে । কেননা সময়ের দ্বান্দ্বিক সংঘর্ষের কথা আছে , যূগ বিপর্যয়ের কথা আছে , মরাল সংকটের কথা আছে । অন্যরা বলল , খুব বেশী বুদ্ধিবাদি , বাকসর্বস্ব । এমন রচনার আয়ুষ্কাল কম । এই দলের পালের গোদা মার্ক্সবাদী অমরেশ গাঙ্গুলী । কুমারেশ চক্রবর্তী, অমিতাভ রায় সেবাব্রতরাও ঝাণ্ডার তলায় ছিল । গৌতম , অরূপ , দীপঙ্করকে দেখলে ওরা অস্থির , বিরক্ত, ধর্য্যহীন হয়ে যেত । শহর দিল্লির সংস্কৃতি মহলে পরস্পরের মধ্যে ছিল হিংসা , রেষারেষি, খিঁচতানী অন্যান্য জায়গার তুলনায় কিঞ্চিৎ বেশী - বিশেষ করে সেরা মানুষেরা, যারা গদ্যপদ্যের কারোবারি । সবাই যে যার মত মঠ মসজিদ-সুঁড়িখানায় যায় - একে অন্যকে হ্যাক্‌ থুঃ করে - সবাই সবার এনিমি ।

কেউ কেউ বলল "আরে অত দীর্ঘশ্বাস ফেলছ কেন ? হিংসা রেষারেষি তো থাকবেই, মানুষ তো দেবতাত্ম নয় - পশুত্ব নয়  সে এক অদ্ভুত সচেতন কীট ।

1 comment:

  1. মন ভরল না ৷ বিস্তাারিত আলোচনা হলে ভাল লাগত ৷

    ReplyDelete

Facebook Comments